মোঃ নুরুজ্জামান শেখ গাজীপুরঃ
গত ৫ই আগস্টের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শিথিল তৎপরতার সুযোগে গাজীপুরের টঙ্গীর বেশ কয়েকটি এলাকায় চুরি, ছিনতাই ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেড়েছে।
স্থানীয় এলাকাবাসী এসব ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়েছেন। তারা জানিয়েছেন, দিনের বিভিন্ন সময়ে টঙ্গীর বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাইয়ের কবলে পড়ছে সাধারণ মানুষ। তবে সন্ধ্যার পর হতে গভীর রাত পর্যন্ত এসব ঘটনা ঘটছে বেশি। এতে অনেকে সর্বস্ব হারাচ্ছেন; কারও যাচ্ছে প্রাণ। টঙ্গী পূর্ব ও পশ্চিম থানা পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, গত এক সপ্তাহে পুলিশের হাতে নানা অপরাধে অন্তত ৪২ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন।
২০ অক্টোবর সন্ধ্যায় গাজীপুরা বাঁশপট্টি এলাকায় ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন তৈরি পোশাক কারখানার কর্মী ফাতেমা বেগম। তিনি বুধবার আমাদের বলেন, তিন-চারজন ছিনতাইকারী ছোরা ও খুরের ভয় দেখিয়ে তাঁর কাছ থেকে ব্যাগ ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়। এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ করেছেন কিনা জানতে চাইলে ওই নারী বলেন, ‘থানায় অভিযোগ কইরা লাভ নাই। যা গেছে, তা কি ফেরত পাওয়া যাইব?’
১২ অক্টোবর রাত ৯টায় মিলগেট এলাকায় ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী কামাল উদ্দিন। তিনি হা-মীম গ্রুপের সিসিএল-৩-এর কাটিং ম্যানেজার।
কামাল উদ্দিন বলেন, কর্মস্থল থেকে বাসায় ফিরছিলেন। হঠাৎ অলিম্পিয়া টেক্সটাইল মিলের ভেতর দুই ছিনতাইকারী তাঁকে ছোরা ধরে মোবাইল ফোন ও টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। পরে শ্রমিকরা এগিয়ে এসে দু’জনকে ধরে পুলিশে দেন। কামাল উদ্দিনের ভাষ্য, এই এলাকায় প্রায় প্রতিদিনই ছিনতাই হয়েছে বলে শুনেছেন।
গোপালপুর এলাকার আবুল হাসেম নামে একজন জানান রাত ১০টার সময় চেরাগআলী হতে রিকশা বাসায় যাওয়ার সময় মেঘনা রোড এলাকায় আসলে ৪/৫ জন যুবক দেশীয় অশ্র ঠেকিয়ে মানিব্যাগ ও মোবাইল ছিনিয়ে নেয় বাধা দিলে খুর দিয়ে আঘাত করে।
টঙ্গী রেলওয়ে স্টেশন এর জামালপুর গামী এক যাত্রী জানান ট্রেনের জানালা দিয়ে আমার হাতে থাকা মোবাইল ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারী।
শিল্পঘন টঙ্গী এলাকায় প্রতি মাসের শুরুতে ছিনতাই বেড়ে যায়। পোশাক কারখানার কর্মকর্তা ও শ্রমিকরা জানিয়েছেন, বেতন দেওয়ার সময়েই এসব অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপরাধীদের বিরুদ্ধে খুব কমই ব্যবস্থা নেয়। সপ্তাহখানেক অনুসন্ধান চালিয়ে টঙ্গীতে ছিনতাইপ্রবণ ২৮টি এলাকার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব জায়গার মধ্যে রয়েছে স্টেশন রোড ও উড়াল সেতু; নতুন বাজার রেলগেট, রেল স্টেশন,মেঘনা রোড, টঙ্গী বাজার ও উড়াল সেতু;নদী বন্দর, হাজী মাজার বস্তি, মিরেশপাড়া, আরিচপুর, শিলমুন, মরকুন, হকের মোড়,নিমতলী, টঙ্গী রেলব্রিজ,প্রত্যাশা মাঠ, এরশাদনগর বাঁশপট্টি, খরতৈল, সাতাইশ বাগানবাড়ি, হোসেন মার্কেট, বড় দেওড়া সিংবাড়ি মোড়, কামারপাড়া রোডের মাথা, গুটিয়া ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, গাজীপুরা খাঁ-পাড়া দিঘীরপাড়। এলাকাবাসী জানিয়েছে, এসব জায়গা সন্ধ্যার পর চলে যায় ছিনতাইকারীদের দখলে। তখন একাকী চলাচল করাই অনিরাপদ। ভয়ে বেশির ভাগ শ্রমিক দলবদ্ধ হয়ে বাসায় ফেরেন।
এলাকার বাসিন্দাদের দেওয়া তথ্যমতে, প্রতিটি এলাকায় সপ্তাহে ২০-২৫টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। তাদের অভিযোগ, বেশির ভাগ ঘটনায় পুলিশ মামলা নিতে গড়িমসি করে। কিছু ঘটনায় মামলা নথিভুক্ত করা হলেও ছিনতাই হিসেবে না দেখিয়ে এজাহারে ‘ডাকাতির প্রস্তুতি’ উল্লেখ করা হয়। এ জন্য ভুক্তভোগীরা পুলিশের কাছে যেতে চান না।
২৪ সেপ্টেম্বর কামারপাড়া রোডে ছিনতাইয়ের শিকার হন রাকিবুল নামের এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, ‘অল্পবয়সী ৩-৪ জন ছেলে পথ আটকেই আমাকে চড়থাপ্পড় মারতে থাকে। পরে ছুরি ধরে ভয় দেখিয়ে ১০ হাজার টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়।’ রকিবুলের ভাষ্য, কয়েক মাস আগেও ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছিলেন তিনি। তখন থানায় গিয়ে লাভ হয়নি। তাই ঘটনার পর আর যাননি।
৩ সেপ্টেম্বর রাতে এরশাদনগর-টেকবাড়ি সড়কের পাশে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে প্রাণ যায় ফরিদ হোসেন নামে এক ব্যবসায়ীর। ১৬ অক্টোবর রাতে দত্তপাড়া তিস্তার গেট এলাকায় সাব্বির হোসেন (১৮) নামে এক যুবককে ছিনতাইকারী সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করে জনতা। পরে জানা যায়, তিনি অটোরিকশাচালক ছিলেন। এ ঘটনায় মেজবাহ উদ্দিন (৩৬) নামে এক ব্যক্তি আহত হন।
২৩ অক্টোবর ভোরে রেলগেট এলাকায় ছিনতাইকারীরা সেলিম বেপারীর মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়। তিনি বলেন, ‘সকালবেলা হাঁটতে বের হয়েছি। এ সময় ছিনতাইকারীরা আমার হাত থেকে ফোনটি নিয়ে চলে যায়।’
এদিকে কয়েকটি এলাকায় পকেটমার চক্রের সদস্যরা সক্রিয়। স্টেশন রোডে সোমবার বাসে মোবাইল ফোন খোয়া যায় গাজীপুরার বাসিন্দা রফিকুল ইসলামের। তিনি বলেন, ঢাকা থেকে বলাকা পরিবহনের বাসে বাসায় ফিরছিলেন। বাসটি স্টেশন রোডে পৌঁছামাত্র কিছু লোক হুড়মুড়িয়ে বাসে ওঠে। এ সময় ভালো করে দাঁড়ানোর জায়গাও ছিল না। তাঁর মোবাইল ফোনটি হাতে ছিল। খানিক দূর যাওয়ার পর একটি ছেলে সেটি টান দিয়ে দ্রুত বাস থেকে নেমে যায়।
টঙ্গী পূর্ব ও পশ্চিম থানায় এক সপ্তাহে ছিনতাই ও ডাকাতির প্রস্তুতির ঘটনায় ৪৩টি মামলা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, পূর্ব থানায় এ সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৩৪ জনকে। তাদের মধ্যে ছিনতাইকারী ১৫ জন। এ ছাড়া চুরির মামলায় দু’জন, হত্যা মামলায় তিনজন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আসামি চারজন এবং অন্যান্য মামলায় ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আর পশ্চিম থানায় গ্রেপ্তার আটজনের মধ্যে ছয়জনই ছিনতাইয়ের ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়। আর ডাকাতি প্রস্তুতি মামলায় দু’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সপ্তাহখানেক আগে টঙ্গী পূর্ব থানার ওসি হিসেবে যোগ দিয়েছেন কায়সার আহমদ। তিনি বলেন, এই সময়ের মধ্যে ছিনতাই, চুরি, হত্যা, গ্রেপ্তারি পরোয়ানাসহ অন্যান্য মামলায় ৩৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। অপরাধের সঙ্গে আপস করবেন না জানিয়ে তিনি বলেন, পুলিশের অভিযান চলছে। তবে এ জন্য টঙ্গীর জনগণের সহায়তা কামনা করেন।
জিএমপির উপকমিশনার (অপরাধ-দক্ষিণ) আলমগীর হোসেন বলেন, টঙ্গী ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। এখানে প্রায় ১৯টি বস্তি রয়েছে। বাসিন্দাদের মদ্যে অনেকে বেকার। এদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হলে ছিনতাই কমে যেতে পারে।